আত্মকথা- আতিয়া ফারজানা রোদেলা


আজ সকালটা শুরু হলো কান্না দিয়ে। কি জানি মন বললো কাঁদতে... খুব কাঁদলাম! আমার মা আর বোন খেয়ালও করে নি!...

এমন হলো এটা প্রথমবার নয়। আমার সাথে এমন ২০১৩ থেকেই হয়। আমার পরিবার এতটুকু জানে যে আমি একা থাকতে ভীষণ ভালোবাসি। নিজের দুনিয়া নিয়ে ব্যস্ত আমি।  খুব ভালই আছি। হ্যাঁ হয়তো আসলেই ভাল আছি।  

২০১২ সালে প্রথম পি এস সি দেই। প্রথম বোর্ড পরীক্ষা আমার জীবনের।  তখন জিপিএ কি বুজতাম না। জিপিএ-৫ পাওয়া যে কতটা জরুরী জানতাম না বা বলতে পারেন বুজতাম না।  বড় বোনকে জিজ্ঞেস করেছিলা "বোর্ড এক্সাম কি আবার?" বড় বোন বলেছিলো 'ও তেমন কিছু না! স্কুলে যেমন পরীক্ষা দিস, তেমনই পরীক্ষা কিন্তু অন্য স্কুলে গিয়ে দিতে হবে এতটুকুই। 

আমি ভাবলাম, 'এ আবার আহামরি কি! তা না হয় অন্য স্কুলেই পরীক্ষা দিব।'

সেবার আমি জিপিএ-৫ পাইনি। অথচ ক্লাসে আমার রোল ছিল ৩। আমি যা পেয়েছিলাম তাতে খুশি ছিলাম। কিন্তু আমার বাবা খুশি ছিলেন না। ঘরের সবাই যখন বকতে শুরু করলো তখন বুজতে পারলাম আমার রেজাল্ট ভাল হয় নি। কান্না করেছিলাম বকা শুনে। তার উপর বাড়ীওয়ালার মেয়ে জিপিএ-৫  পেয়েছে বলে মিষ্টি পাঠানো হয়।  মিষ্টি নিয়ে আমাকে বলা হলো, 'সারা জীবন অন্যের সাফল্যের মিষ্টিই খেয়ে যাবি।' খুব কেঁদেছিলাম। রাতে খাবার খেয়ে ঘুমাতে যাওয়ার সময় ভেবে ছিলাম কাল সব ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু কিছুই ঠিক হয় নি।  

এরপর ৬ষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণীতে উঠা পর্যন্ত আমাকে কথা শুনতে হতো শুধুমাত্র জিপিএ-৫ পায়নি বলে। অষ্টম শ্রেণীতে উঠার পর বড় বোন বাবাকে বলল কোচিং এ ভর্তি করাতে। বাবা বলল, 'ভর্তি করিয়ে কি হবে? ও তো এবারো এ প্লাস  বা জিপিএ-৫ পাবেনা।'

কলিজায় অনেক কামড় লাগতো কথাগুলো শুনে।জীবনে প্রথম কোচিং এ ভর্তি হয়। এত ভাল স্টুডেন্ট এর মাঝে আমি!  নিজেকে নগণ্য মনে হতো.... কোচিংয়ে ওত ভালো নাম্বার পেতাম না শুরুতে। পরীক্ষার এক মাস আগে আমার অবস্থা ভাল ছিল। কিন্তু ওই যে বাবা বলেছিলেন আমি এবারও এ প্লাস পাব না, এ কথাটা মনে ভয় জাগাতো। পরীক্ষা শেষ হবার পর বাবা আমার সমবয়সী কাজিনকে জিজ্ঞেস করেছিল সেকি আত্মবিশ্বাসী যে সে এ + পাবে? সে বলেছিল সে আত্মবিশ্বাসী। যখন আমায় জিজ্ঞেস করল, আমি বললাম, 'সব সময় বলবে আমি এ প্লাস পাব কিনা! কেন বলিনি আমি এ প্লাস পাব জানেন? এই ভয়ে যদি না পাই তাহলে তো একথা বলার জন্য বকা শুনতে হবে।

রেজাল্টের দিন সকাল থেকে কাঁদছিলাম। যাক! এবার জিপিএ ৫ পেয়েছি। কিন্তু তাতে আমার বাবা খুশি হননি। আমাকে বললেন, 'গ্রামে থাকা তোর কাজিন ও এ প্লাস পেয়েছে ও তোর থেকে বেশি কষ্ট করেছে।'

কিন্তু নবম-দশম শ্রেণীতে তারা আর কথা শোনালো না। কি আদর!.. যেন রেজাল্ট নির্ধারণ করে কতটুকু আদর যত্ন করতে হবে। দুটো বছর বেশ ভালো গিয়েছিল। স্কুল, কোচিং সবখানে ভালো রেজাল্ট ২০১৮ সালের  রেজাল্টে এ প্লাস আসলো না। তারা এমন একটা ব্যাবহার করল যেন তাদের টাকা লস হয়েছে কিন্তু আমার কিছুই হয়নি।
আমি যে সময় এবং পরিশ্রম দিয়েছিলাম তা ব্যর্থ হয়েছে সেটা কারো চোখে পড়ল না। রেজাল্ট দিয়েছিল ০৬ মে, ২০১৮! আমার বড় বোন রেজাল্ট জানার পর বলল, 'আর একটু সিরিয়াস হলে আছে এদিন দেখা লাগতো না তোর।' আমি থমকে গিয়েছিলাম। আর কত সিরিয়াস হলে রেজাল্ট ভালো হতো? সকাল পাঁচটায় ঘুম থেকে উঠে নামাজ পড়ে পড়তে বসতাম। সারাদিন পড়ার মধ্যে ঢুকে থাকতাম। আর কত সিরিয়াস হলে সিরিয়াস হওয়া   বুঝায়।

 মন ভেঙে গিয়েছিল কিন্তু পরিবার আসেনি আমায় সহায়তা করতে। শুরু হল আরেক যাত্রা তারা কলেজে ভর্তি করালো এরপর তিন মাস চলে যায় বই কিনে দেয় না, খাতা কলম পেন্সিল টা পর্যন্ত কিনে দেয় না। কোচিং এ ভর্তি করানো তো দূরের কথা।
বড় বোন কোনমতে তার টিউশনের টাকা দিয়ে দু একটা বই কিনে দেয়, খাতা কিনে দেয়। টিউশন আমিও করাতে চাইলে আমাকে তারা টিউশন করতে দিবেনা। ইন্টার প্রথম বর্ষের প্রথম সেমিস্টার এর এমসিকিউ তে ১ মার্কের জন্য ফেইল আসে। বাবার প্রশ্ন, 'আমি কেন ভালো রেজাল্ট করলাম না?' বান্ধবীদের কাছ থেকে 
বই চেয়ে ছবি তুলে পড়তাম বা ফটোকপি করতাম। এটা তাদের চোখে পড়ল তাদের মনে হয়নি বই কিনে দেবার কথা। যাওয়া-আসার ভাড়া জমিয়ে একটা একটা করে বই কিনতে কিনতে ইন্টার দ্বিতীয় বর্ষে উঠে যায়। তখন তাদের মনে পড়ে কোচিং করাতে হবে। ততদিনে অনেক কিছুই পড়ানো হয়ে গিয়েছে কোচিং সেন্টারগুলোতে।

ভেবে রেখেছিলাম ইন্টারে খুব পড়ব। আমার পরিবারের আচার আচরণ দেখে বুঝে গিয়েছিলাম আমার আগের মত পড়ার সুযোগ নেই। আত্মবিশ্বাস আর পড়ার ইচ্ছা দুটোই মরে গিয়েছিলো। পড়তে বসলে সব কথা মাথায় ঘুরতো। চোখ দিয়ে পানি পড়তো বইয়ের পৃষ্ঠা ভিজে যেত। কিন্তু চোখের পানি ঝরা বন্ধ হতো না। কেউ দেখিনি আমার এই অবস্থা, কেউ না!! 
 খুব সহজ বলা, পরিবারের সাথে ফ্রেন্ডলি হও। আমার হাজার চেষ্টায়ও পারিনি তাদের সাথে মিশতে। কোনো না কোনো ঘটনা ঘটতই, যেন ঘরে ঝগড়া লাগে আর সব লন্ডভন্ড হয়ে যায়।

২০১৮ থেকে নিজের সাথে লড়তে লড়তে আমি ক্লান্ত। অনেক চেষ্টা করেছি নিজের আত্মবিশ্বাস ফিরিয়ে আনতে।
পারেনি।
২০১৮ থেকে এখন পর্যন্ত এমন কোনোদিন যায়নি যেদিন আমি চোখের জল ঝরায় নি।
 কাকে বলব?
পরিবারের কাউকে বললে, তাদের কি আছে সেই ধৈর্য যে শুনবে আমার কথা? চেষ্টা করেছে পারেনি বুঝতে।
এমন রোজ হয়!!!
সকালটা চোখের জল দিয়ে শুরু হয়।


জীবনে রেজাল্টই সব হয়তো। রেজাল্ট ভাল হলে আদর যত্ন পাবে আর খারাপ হলে কটুকথা এবং অবহেলা।

Comments

  1. Tor sathy amr mile gese ☺ amr cls-1 theke suru hoise
    Jni nh HSC te ki hbe 🙃 r koto obohela r koto kotha sunte hbe ☺☺

    ReplyDelete
    Replies
    1. আপনি রোদেলাকে এই কথাটা ইনবক্সে বলেন।

      Delete

Post a Comment

Popular posts from this blog

রম্য গল্প : বয়ফ্রেন্ড বিড়ম্বনা। ______________লিখা : Sumaiya Mannan Borna

আকুল আবেদেন ______তানজিনা___আফরিন____বিথী

বর্ষার ভালবাসা------ আশরাফুল হক